Tuesday, May 1, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৮৯ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত

ওয়িয়েন্টালাইজিং ইন্ডিয়া
উনবিংশ শতাব্দের প্রথম পাদে ব্রিটিশেরা ভারতীয় অভিজাত এবং রাজাদের তুলনায় রাজকীয় জাঁকজমকপূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ পরিধেয় পরা থেকে বিরত ছিল। অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশদের অনুসরণ না করে তারা রেশম সাটিন, ঘরে পরা কম রঙের জোব্বা, ব্যাগি প্যান্ট আর শোয়েটশার্ট আর ভেস্ট পরত। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি শোলা টুপি জনপ্রিয় হওয়ার আগে তাদের মাথায় থাকত বিভার স্টোভিপাইপ হ্যাট বা ক্যাপ। সরকারি কোন অনুষ্ঠানে দেশিয় রাজারা মুঘল রাজদরবারে যাওয়ার পোষাক পরতেন। সেই তুলনায় সাদা শাসকেরা খুব যে ভাল আর প্রভাবশালী কাপড় পরতেন সেটা বলা যাবে না বরং তাদের কাপড় অনুজ্জ্বল ছিল। ব্রিটিশেরা অন্তত পোষাকে লড়াই করার আশা ছেড়ে দিয়ে তাদের শাসন ক্ষমতা দিয়ে বাহ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রণের উদ্যম নিয়েছিলেন।
ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে উঠে বললেন ঔপনিবেশিক প্রশাসকের মতই ভারতের প্রশাসনিক সেবার আমলাদের একটা নির্দিষ্ট পোষাক থাকা উচিত। ভারতের প্রশাসকেরা অন্যান্য উপনিবেশের প্রশাসকদের থেকে এক্কেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল। ভারত শাসন হত ইন্ডিয়া অফিস মার্ফত, অন্যান্য উপনিবেশ শাসিত হত উপনিবেশ দপ্তর মার্ফত। রাণী আলাদা করে পোষাকের বিষয়ে উৎসাহিত হুওয়ার পরও বহুবার বিশেষ পোষাকের প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু ভারতীয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিল যে তাদের কর্মচারীদের ওপর পোষাকের বোঝা চাপিয়ে দেবে না তারা।
১৮৭৬ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত ভারতের ভাইসরয় লিটন কিন্তু ভারত শাসনের প্রয়োজনে বাহ্যিক আড়ম্বরপূর্ণ জাঁকজমক এবং দেখনদারির খুব বড় ভক্ত ছিলেন। তিনিও রাণীকে অনুযোগ করে লিখলেন ভারতের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলি ফ্যান্সি ড্রেস বলের মত, ফলে আমলাদের পরিধেয়তে কোন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বিংশ শতাব্দের প্রথম পর্যন্ত ভারতীয় প্রশাসনিক সেবায় কোন রকম পোষাকের পরিকল্পনা না করা গেলেও, লন্ডনের এবং অন্যান্য উপনিবেশের তৃতীয় এবং পঞ্চম শ্রেণীর ব্রিটিশ আমলারা যে রকম অতিথিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্যে তৈরি পোষাক পরে তাদের মত করে ভারতীয় উচ্চশ্রেণীর আমলারা প্রশাসনিক পোষাক পরে। যে সব আমলার দেশিয় রাজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, তারাই একমাত্র নির্দিষ্ট ধরণের পোষাক পরে। এই পোষাকের মধ্যে ছিল নীল কোটে সোনার জরির কাজ, সঙ্গে কালো ভেলভেট লাইনিং, কলার আর কাফ, দুই ইঞ্চি সোনার লেস দিয়ে ধার বোনা নীল কাপড়ের ট্রাউজার, উটপাখির পালক যুক্ত বিভার ককের টুপি আর তরোয়াল।

গাইকোয়াড এবং রাজা
১৯১১ সালে ঔপনিবেশিক দরবারে পোষাক পরা নিয়ে যে ঘটনা ঘটে গেল, তার থেকে আমরা বুঝতে পারি ব্রিটিশ পক্ষ ভারতীয় রাজাদের থেকে কি ধরণের পোষাক চাইছিল। ১৯১১ সালে পঞ্চম জর্জ এবং তাঁর রানী সিংহাসনে আরোহনের উৎসব পালন করতে ভারতে ঘুরতে এসেছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে এই একবারই কোন সিংহাসনারূঢ ব্রিটিশ রাজা ভারতে ঘুরতে আসেন। তিনটি ঔপনিবেশিক দরবার একই সময়ে শুরু হয়। প্রথম দুটিতে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয় যেখানে ভাইসরয় রাজার মুকুটটা রেখেছিলেন। ১৯১১র উতসবের তৈরি হয়েছিল একটি বিশাল মঞ্চ, তার ওপরে একটি আরও বিশাল শামিয়ানা কাপড়ের ঝালর দেওয়া যাকে বলা হচ্ছিল হোমেজ প্যাভেলিয়ন, যেখানে রাজা আর তার রাণী সিংহাসনে বসবেন। আগের দরবারটিতে ভারতীয় রাজা আর অভিজাতরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় অবস্থার দর্শক ছিলেন; এবারে ঠিক হল গুরুত্বপূর্ণ রাজারা তাদের মত করে তাদের ঔপনিবেশিক রাজাকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা জানাবেন।
বরোদার গাইকোয়াড ছিলেন চরমতম ইওরোপপন্থী, আচার বিচারে এবং পোষাকে। তাকে ইওরোপিয় প্রশাসকেরা প্রগতিশীল রাজা হিসেবে গণ্য করত। একই সঙ্গে তিনি বহু জাতীয়তাবাদী নেতারও বন্ধু ছিলেন(বরোদাতে চরমপন্থী শ্রীঅরবিন্দ প্রথম জীবনে ১৫০০ টাকায় চাকরি করতেন। সরলা দেবীও বোধহয় ছিলেন পড়াতে - অনুবাদক)। ভারতে যে কটা সরকার ঔপনিবেশিক দরবার প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের শ্রেণী বিভাগে হায়দ্রাবাদের পরেই ছিল বরোদার স্থান। ফলে গাইকোয়াডের শ্রদ্ধা দেখানোর সুযোগ আসবে হায়দ্রাবাদের অনুষ্ঠানটা হয়ে যাওয়ার পরেই। বরোদায় মূল উতসবটা শুরু হওয়ার আগের দিন মহড়া হচ্ছিল কিভাবে গাইকোয়াডের রাজা উপনিবেশের সম্রাট এবং তাঁর রাণীকে সম্মান প্রদর্শন করবেন। তাদের বলা হল মঞ্চের দিকে সিঁড়িতে উঠে তাঁরা রাজার সামনে মাথা নিচু করবেন এবং পেছনে ফিরবেন এমন করে যাতে সম্রাট আর তার রাণীকে তাদের পিছন দেখতে না হয়। গাইকোয়াডের রাজা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না পেরে তার ভাইকে পাঠালেন বিষয়টা বুঝে আসতে।

শ্রদ্ধা জানানোর দিন গাইকোয়াডের রাজা একটা সাধারণ হাঁটুঝুল জামা পরলেন আর পরলেন পারম্পরিক পাগড়ি। সঙ্গে সাদা ইওরোপিয় ট্রাউজার আর ব্রিটিশ হাঁটার লাঠি। তাঁকে দেওয়া স্টার অব ইন্ডিয়ার কোন কিছুই তিনি পরে আসেন নি, যদিও সবার তাই আশা ছিল। গাইকোয়াড রাজার দিকে এগিয়ে একবার মাথা নিচু করলেন, তারপরে নিজে ঘুরে হাতের বেতের ছিড়িটি দোলাতে দোলাতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। মনে হয় সেই সময় তার কাজ নিয়ে কেউ কোন প্রতিবাদ করে নি। কিন্তু টাইমসের সাংবাদিক লিখলেন তার কাজটা রাষ্ট্রবিরোধী, বিদ্রোহীর। এরপরে ভারতে আর ইংলন্ডের ইংরেজি খবর কাগজগুলিতে এই ঘটনার চুলচেরা বিচার শুরু হয়ে গেল, সক্কলের অভিমত এই আচরণ উদ্দেশ্যপূর্ণ বিদ্রোহী অপমান। ঘটনার তিন হপ্তা পর যখন দরবারের নিউজলেটারটি ইংলন্ডে পৌঁছল তখন আরেকটি ঝড় উঠল। ২৯ জানুয়ারি ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ সেই ঘটনায় তোলা চলচ্ছিত্র থেকে একটা ছবি তুলে নিয়ে ছাপল যেখানে দেখা যাচ্ছে বরোদার রাজা সাম্রাজ্যের রাজার দিকে পিছন ফিরে হাতে ছড়ি নিয়ে নেমে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে তারা দুজন রাজার ছবি ছাপল যারা ইংলন্ডের রাজাকে গভীর ভাবে মাথা নামিয়ে শ্রদ্ধা আর নিবেদন জানাচ্ছেন। গাইকোয়াড আর তার দরকারের সদস্যরা এই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানালেন। বললেন এতা ব্যক্তিগত কারণে ঘটেছে, ঐদিন রাজা মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন, তাই বুঝতে পারেন নি কোন ধরণের আচরণ করতে হবে। তার রাজার প্রতি কোন রকম অসম্মান দেখানোর ইচ্ছে ছিল না। 

No comments: