Thursday, February 15, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১ - সিরাজ চরিত্র যাঁদের লেখা দিয়ে বিচার হয় - সুশীল চৌধুরীর বয়ানে

'সিরাজদ্দৌল্লা সত্যি সত্যিই ভিলেন জাতীয় নিকৃষ্ট জীব ছিলেন কি না তা বিচার করার আগে যাঁরা তাঁর সম্বন্ধে এ অভিযোগ করেছেন তাঁদের সম্যক পরিচয় জানার একান্ত প্রয়োজন।এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার বেশিরভাগ ফারসি ইতিহাসই পলাশীর প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরে লেখা, যখন ঐ ঘটনাবলী সম্বন্ধে উক্ত লেখকদের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে।তাছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল যে ফারসি ইতিহাসগুলির বেশিরভাগই লেখা হয়েছিল ওইসব লেখকদের ইংরেজ প্রভু বা মনিবদের আদেশে বা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাই এগুলিকে সে যুগের ঐতিহাসিক তথ্যের প্রকৃত সূত্র হিসেবে গণ্য করা যায় কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। সিরাজদ্দৌল্লাকে 'ভিলেন' বা দুর্বৃত্ত প্রমান করা গেলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যথার্থ্য প্রমান করা সহজ হয় অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বলা যায়যে ইংরেজরা বাংলা জয় করে এক স্বেচ্ছাচারীর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করেছে। এতে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা মিলবে। ফলে পলাশী ষড়যন্ত্রের চক্তান্ত করা সত্ত্বেও ইংরেজদের ভূমিকা ততটা নিন্দনীয় হবে না।' সুশীল চৌধুরী, পলাশীর অজানা কাহিনী
সিরাজের বিষয় নিয়ে আমরা এর আগে একটা লেখা দিয়েছিলাম। সেটাও সুশীলবাবুর বয়ানে। সিরাজের চরিত্র সেখানে তিনি বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন, নবাব হওয়ার আগে এবং পরে সিরাজ দুটি ভিন্ন মানুষ। অথচ সিরাজের ভিলেনি সম্বন্ধে প্রায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ঐক্যমত্য দ্যাখা যায়। সিয়ারেমুতক্ষরিণএর লেখক গোলাম হোসেন খান সব থেকে বেশি সোচার। তাঁর সম্বন্ধে প্রচুর কটুক্তি করেছেন। রিয়াজেও গোলাম হোসেন সেলিমও কড়া সমালোচনা করেছেন। বিপুল সমালোচনা করেছেন ফরাসি কুঠের প্রধান জাঁ ল, ইংরেজ কুঠিয়াল লুক স্ক্রাফটনও।নীচে এদের নিয়ে আলাদা আলাদা করে আলোচনা করব।
এই কিস্তিতে গোলাম হোসেন খান।
১) সিররেমুতক্ষরিণের প্রণেতা গোলাম হোসেন খান।
সেযুগের নামি ঐতিহাসিক এবং সিরাজের কট্টর সমালোচক। আলিবর্দির বাড়ির হাজি বা বাড়ির সরকার। প্রথম থেকেই গোঁড়া ইংরেজ ভক্ত এবং সিরাজ বিরোধী। করম আলির ভাষায় ইংরেজদের বন্ধু হিসেবে তাদের ওকালতি করায় তাঁর চাকরি খুইয়েছিলেন এবং সিরাজ তাঁকে প্রাণে না মেরে বাংলা থেকে বহিষ্কার করেন। এই গোলাম হোসেন খানই শওকত জঙ্গকে প্ররোচিত করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে এ-ব্যাপারে(পলাশী) অগ্রসর হতে কারণ শোনা যাচ্ছে যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করতে চায়।পরে মীর কাশেমের প্রিয়পাত্র হিসেবে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন।
সিরাজ ইংরেজদের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে বিবাদ করছে এই তত্ত্বটা গোলাম হোসেন খানএর তৈরি। ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব এবং চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন তিনি লেখেন - 'এই জাতির(ইংরেজ)... শক্তি, সাহস ও মনোবলের কোনও তুলনা হয় না', বা 'এই জাতির সেনাপতিরা অত্যন্ত দক্ষ, সতর্ক ও সব ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এরা অসম সাহসী।' তিনি আরও লেখেন, 'এই জাতি কোনও সঙ্গত কারণ ছাড়া কারও সঙ্গে বিরোধ বাধায় না। তিনি আলিনগরের চুক্তি ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইংরেজদের দায় ছাড় দিয়ে লেখেন, ...সম্ভবত কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণে নবাবের সঙ্গে বিরোধ করা ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না। ...অবশ্য এ বিষয়ে আমার কাছে সঠিক কোনও তথ্য নেই তবে মনে হয় সম্ভবত নবাব(শর্ত অনুযায়ী) টাকা পয়সা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং অকারন দেরি করছিলেন।'
পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের সঙ্গে বিজয়ী হয়ে সিরাজ মোহনলালকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন গোলাম হোসেনে আর তার পরিবারের কোনও অনিষ্ট না হয়, তারা যেন নির্বিঘ্নে, নিরাপদে চলে যেতে পারেন। সিরাজের নির্দেশে তিনি নিরাপদে বেনারস তাঁর মামা ও ভাইদের সঙ্গে মিলিত হন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো দূরস্থান এই বদান্যতার জন্য গোলাম হোসেন সিরাজকে ধন্যবাদ তো জানানই নি এ প্রসঙ্গে তিনি পরে লেখেন, তাঁরা অত্যাচারী নবাবের হাত থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর আরও অভিযোগ সিরাজ নাকি জগতশেঠকে সুন্নত করার হুমকি দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন কোন তথ্যেই সমর্থিত নয়।
বিশদে লেখার এখানে অবকাশ নেই, উতসাহীরা সুশীলবাবুর বইটা আরও বিশদের জন্য পড়ে নিতে পারেন।
পরের কিস্তিতে রিয়াজ লেখক গোলাম হোসেন সালিম এবং করম আলির বয়ান।

No comments: