Wednesday, December 13, 2017

উপনিবেশপুর্ব বাংলা - বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য৮

রণবীর চক্রবর্তী

বিনিময় মাধ্যম
অনেকেই ভেবেছেন চুর্ণি হল শুদ্ধ সোনা বা রূপোর গুঁড়ো। সে সময়কার তথ্যসূত্রে একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে পুরাণ অর্থাৎ রূপো আর সুবর্ণ অর্থাৎ সোনার মাপেই এই দামি ধাতু গুঁড়ো বিনিময় মাধ্যম হিসেবে বিক্রি হত। এই গুঁড়ো মুদ্রা ব্যবসায়ীদের কাছে তখনই গুরুত্বপূর্ণ বিনিময় মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, যখন তাঁরা অনুভব করেন, চলতি মুদ্রার মান আর মুদ্রায় ধাতুর শুদ্ধতায় ঘাটতি দ্যাখা দিচ্ছে, অথবা সেগুলি পাওয়া সহজ হচ্ছে না। সোনা রূপোর চুর্ণি মুদ্রা, সোনা রূপোর দিনার/সুবর্ণ বা দ্রম্ম/কর্ষাপণের সঙ্গে বিনিময় করা যেত; বা পুরাণ বা সুবর্ণের ওজনের চুর্ণি কপর্দক বা কড়ির সঙ্গে বিনিময় করা যেত। ওপরের আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে মধ্যযুগের শুরুতে জটিল আর্থব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল। ত্রি স্তরীয় আর্থব্যবস্থার আমরা আন্দাজ পাচ্ছি – এক্কেবারে ভূমিতলে থাকত কড়ি বা কপর্দক, দামি ধাতুর মুদ্রা মধ্যিখানে এবং সর্বোচ্চ স্তরে নতুন ভাবনার গুঁড়ো মুদ্রা।
(বইসূত্রঃBarrie M Morrison, Political Centres and Cultural Regions in Early Bengal, Jaipur, 1980; BN Mukherjee, 'Kharoshti and Kharoshti-Brahmi Inscriptions from West Bengal (India)', Indian Museum Bulletin, 25, 1990; External Trade of North-Eastern India, New Delhi, 1992; Vimala Begley, 'Ceramic Evidence of Pre-Periplus Trade on the Indian Coast', in Vimala Begley & Richard Daniel de Puma, ed, Rome and India, the Ancient Sea Trade, Delhi, 1992; Ranabir Chakravarti, 'Maritime Trade and Voyages in Ancient Bengal', Journal of Ancient Indian History, Calcutta, 1996, 145-71; BN Mukherjee, Coins and Currency Systems of Early Bengal,Calcutta, 2000; Niharranjan Ray, Bangalir Itihas (in Bangla) Calcutta, 1404 BS.

সুশীল চৌধুরী - মধ্যযুগ
অতীতের মতই মধ্যযুগেও ব্যপ্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ছিল বাংলা জুড়ে। মুসলমান শাসনের প্রথম যুগেই বাংলার বিপুল বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন বিদেশে বাণিজ্য করে বিপুল সম্পদ বাংলায় আসত। একটি সূত্র থেকে জানতে পারছি, ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে চিন থেকে দামি ধাতু যেমন সোনা রূপোর সঙ্গে সঙ্গে সাটিন(মলমল), রেশম এবং চিনামাটির তৈজস বাংলায় আসত। অন্য একজন চৈনিক ভ্রমণকারি লিখছেন যে বাংলা এবং চিনের মধ্যে বিপুল বাণিজ্য সম্পাদিত হত রূপোর টঙ্কার বিনিময়ে।
পরের শতেও একই অবস্থা ছিল। ভেনিসের ভ্রমনকারী সেজার দ্য ফ্রেড্রিকি ১৫৬৯ সালে লিখছেন, পেগুর (বার্মা) ব্যবসায়ীরা বাংলায় অন্য কোন পণ্য নয় শুধুই সোনা আর রূপো আমদানি করত। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার বাংলার অর্থনীতিতে ক্রমশঃ মুদ্রার প্রভাব বাড়তে থাকার জন্য বাংলার বদ্বীপ পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি অঞ্চল ধীরে ধীরে ভারত মহাসাগরীয় ব্যবসা শৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। দশম শতে মুসলমান আক্রমনের বহু আগে থেকেই বস্ত্র রপ্তানি পণ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল, কিন্তু সেই সময় শুরু থেকে বস্ত্রের উৎপাদনে বৈচিত্র এবং বাণিজ্য দক্ষতাও নাটকীয়ভাবে বেড়েছিল। ত্রয়োদশ শতকে মার্কোপোলো বাংলার সুতির ব্যবসায়িক গুরুত্ব প্রকাশ করেছিলেন। ১৩৪৫ সালে ইবন বতুতা সূক্ষ্ম মসলিনের বাজার জাত হওয়ার দক্ষতাকে পিঠচাপড়ানি দিয়েছিলেন।

মধ্য যুগে সুতি বস্ত্র আর চাল ছিল বাংলার মূল রপ্তানি দ্রব্য। বাংলার দুটি তৎকালীন দুটি সমুদ্র ব্যবসা উপযোগী বন্দর পূর্বের চট্টগ্রাম আর পশ্চিমের সাতগাঁও ভারত মহাসাগরীয় ব্যবসায় আষ্টেপৃষ্টে লিপ্ত ছিল – এক দিকে পশ্চিম উপকূলের গোয়া অন্য দিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মলুকাস পর্যন্ত তাদের ব্যবসা জাল ছড়ানো ছিল। ১৫৮০ সালে র‍্যালফ ফিচ বলছেন বাংলা থেকে বিপুল পরিমান তুলো রপ্তানি হচ্ছে এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে বাংলার চাল পেগু, শ্রিলঙ্কিয়া, মালাক্কা, সুমাত্রা এবং অন্যান্য এলাকাতেও। কিন্তু সবথেকে বড় বর্ণনা পাচ্ছি পাইরার্ড দা লাভালের বর্ণনা থেকে। তিনি ১৬০৭ সালে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বিপুল চালের আড়ত দেখে লিখলেন, বাংলার চাল যে শুধু বাংলার বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে তাই নয়, গোয়া, মালাবার, সুমাত্রা, মলুক্কাস এবং সুন্দা দ্বীপের বাসিন্দাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে মায়ের ভূমিকা নিয়েছে। মুঘল আমলে উৎপাদিত চালের একটা বড় অংশ উদ্বৃত্ত হত এবং মুঘল আমলে এই পরিমানটা বেড়েছিল। মনরিকে ১৬২৯ সালে বলছেন, সারা বছর ১০০টার বেশি চাল এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য ভর্তি বিশালাকায় জাহাজ বাংলার বন্দরগুলি থেকে ছেড়ে সেই পণ্য রপ্তানির জন্য বিভিন্ন দেশের বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তবে ১৬৭০ সালের পরে পূর্ব দিকের বাণিজ্যে ঘাটতি দ্যাখা দিয়েছিল। 

No comments: