Saturday, September 2, 2017

চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী - সিদ্ধ আন্দোলন ও কৈবর্ত বিপ্লব এবং চুরাশীতি-সিদ্ধ-প্রবৃত্তি

চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী বইটিতে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কৈবর্ত বিদ্রোহের সঙ্গে সিদ্ধ আন্দোলনের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন একটি সংযোজিত প্রবন্ধে। নিচের লেখাটি সেই প্রবন্ধের সারাংশ।

দেশের যে অঞ্চলে, যে যুগে সিদ্ধ আন্দোলনের বিস্তৃতি লাভ করেছিল, মোটের ওপর সেই অঞ্চলেই স্বল্প ব্যবধানে ঘটেছিল কৈবর্ত বিপ্লব - এ তথ্য আজ পরিষ্কার। শুধু এইটুর নজির থেকে সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া বৃথা কি না এই প্রশ্ন তুলে দেবীপ্রসাদ বলছেন একটা বিরাট গণভ্যুত্থানের জন্যে মতাদর্শগত জমি তৈরি করাটাও জরুরি কাজ ছিল। সিদ্ধ আন্দোলন পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে কৈবর্ত বিপ্লবের জমি দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুত করে তুলছিল কি না এই নিয়ে দেবীপ্রসাদ ভেবেছেন। তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলছেন, সে জিজ্ঞাসাটা পেশ করা কি খুবই অবান্তর হবে?

কয়েক মাস আগে আমরা এই ফেবুতে কৈবর্ত বিপ্লব বিষয়ে একটি ভূমিকা লিখেছিলাম - ফলে কৈবর্তি বিপ্লব কী এবং তার পটভূমি এবং ভীম দিব্যোক ইত্যাদি আর আজও দিনাজপুরে শুধু নয় বাংলা জুড়ে তাদের নানান স্মৃতি নানা ভাবে ছড়িয়ে আছে বলেছিলেন বন্ধু Makim এবং অন্যান্যরা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত আবিষ্কার করার পর ঐতিহাসিক মহলে টনক নড়েছিল। উত্তরবঙ্গে কৈবর্তদের নেতৃত্বে প্রকৃতিপুঞ্জ একটি বিশাল ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ভারতজয়ী মহীপালের বিশাল ব্যাপক সেনা বাহিনী বিশাল প্রজাপুঞ্জের তীর-বল্লম-ধনুকের খোঁচায় ছত্রভঙ্গ হল। মহীপাল প্রজাপুঞ্জের হাতে নিহত হলেন। হঠকারী মহীপালের পর রামপাল নানান রাজা সামন্তদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে এই বিপ্লব দমন করেন।

সঙ্গত কারণেই দেবপ্রসাদ কৈবর্তদের নেতৃত্বে ছোটলোকেদের রাজ ক্ষমতা দখলকে বলছেন গণবিপ্লব। তার নিশ্ছিদ্র অনুমান এই গণবিপ্লবের ভিত তৈরি করেন সিদ্ধ বিপ্লবীরা। সেই মতের প্রতিষেধক তৈরি করেন রাজারা দেশজুড়ে পাইকারি হারে বিশাল বিপুল বৌদ্ধ মঠ, বিহার, মন্দির স্থাপন করে। ধর্ম প্রচারকদের জন্য তারা দেদার খরচ করেছেন রাজকোষ থেকে। পাল রাজারা যে বিশুদ্ধ মহাযান পন্থী(উতপন্নক্রম সম্পন্নক্রম প্রভৃতি কর্মফলবাদী আলোচনায় ঋদ্ধ) ছিলেন তাই নয় তারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের যাগযজ্ঞের ব্যাপারেও খুব বেশি উদাসীন ছিলেন না। বিক্রমশীল বিহারে তারানাথের বলি আচার্য বা হোম আচার্যের বিপুল রাজকীয় বর্ণনা শেষে বলছেন রাজত্বের পরমায়ু যাতে সুদীর্ঘ হয় তার জন্য বিপুল রাজকীট যজ্ঞ করেছিলেন যার জন্য ন লক্ষ দুহাজার রৌপ্যমুদ্রা খরচ করেন।

পাল আমলের শেষাশেষি অবস্থা সামাল দিতে রাজ শক্তির পক্ষে অবলোকিতেশ্বরের মৈত্রী, করুণা, বোধিচিত্ত উতপাদনী মহাযানী জীবনাদর্শ প্রচারে বিশাল ব্যাপক আয়োজনের সাক্ষী হচ্ছে বিশাল ব্যাপক লক্ষ লক্ষ শ্রমণ ওয়ালা মঠ, বিহার মহাবিহার।

ঠিক উল্টো দিকে বিপুল গণ অভ্যুত্থান যার চোটে প্রথমে রাজশক্তি মারখেলো এবং ত্রাকে দমন করার জন্য পাল্রাজাদের নিজস্ব বাহিনীর শক্ততে কুলোলো না আশেপাশের শাসক শক্তির দ্বারস্থ হতে হল।

ফলে বোঝা যাচ্ছে সে যুগে শ্রমজীবি মানুষ শুধুই জোড় হাতে অনন্ত করুনার আধার অবলকিতেশ্বরের পায়ে মাথা কোটে নি, তীর ধনুক বল্লমের দিকে হাত বাড়িয়েছিল - সন্ধ্যাকর নন্দীর কথায় মোষের পিঠে চেপে এ জাতীয় অস্ত্র হাতে রাজ সেনা আর সুশিক্ষিত যুদ্ধ কুশল হাতি-ঘোড়ার পালকেও উৎখাত করে ছেড়েছিল।

এই উৎখাতটা সম্ভব হত না যদি না মতাদর্শের জোরটা কৈবর্তদের নেতৃত্বে ছোটলোকেদের থাকত। রামশরণ শর্মা স্পষ্ট দেবপ্রসাদকে বলেছিলেন সরাসরি সম্পর্কের কোন নজির না-দেখানো পর্যন্ত আপনার বক্তব্যে ঐতিহাসিক সাড়া পাবেন না।

কিন্তু কোথায় নিদর্শন? একমাত্র রামচরিত, যেটাকে তিনি বলছেন চাটু-পটু লেখা, রামপালকে স্বয়ং রামের সঙ্গে তুলনা করছেন সন্ধ্যাকর। কবির প্রধান উদ্দেশ্য রামপালের কৈবর্ত বিপ্লব দমন। তাই সেখানে কৈবর্তদের পক্ষে কোন তুচ্ছ সাফাই গাওয়ার সুযোগও ছিল না।

অথচ নীহাররঞ্জন সিদ্ধ আন্দোলন আর বৈবর্ত বিপ্লবের মধ্যে সান্নিধ্য সম্পর্কে তাঁকে বলেছিলেন জিজ্ঞাসা যখন জেগেইছে, তখন একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টায় বাধা কী? সে বাধা দূর হল তার স্ত্রী বিদূষী অলকা চুরাশীতি-সিদ্ধ-প্রবৃত্তি মূল তিব্বতী থেকে বাংলায় অনুবাদ করায়।

তিনি বলছেন সমাজের ওপরের উপরতলার শাসক সম্প্রদায় যে-সব জীবিকা-উপায়কে হেয় ও হীন বলে প্রচার করত যেই বৃত্তিগুলোকে প্রকৃত মর্যাদা দেওয়ার প্রয়াস চুরাশি সিদ্ধ। ফলে তাঁতি-জোলা-জেলে-চাষ-কুমোর-কামার সকলেই আত্মবিস্বাস ও বৃত্তিগত প্রত্র্যয় সৃষ্টির প্রয়াস এই চুরাশি সিদ্ধর দর্শন। যদিও এর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ছকে বাঁধা মহাযানমতের জোলো সংস্করণ - কিন্তু সহজ সাধারণ জীবনে প্রত্যয় তৈরি করতে পারলে কি যে ঘটনা ঘটে তা দেখেছিল পাল সাম্রাজ্য।

যে তত্ত্ব বহু পরে চম্পারণের জনৈক অভয়দত্তশ্রী বর্ণনা করেছিলেন চুরাশি সিদ্ধায়, তাতে সিদ্ধাদের চর্যার নাম পাল্টানোর সুযোগ ছিল না - কিন্তু আধা-তান্ত্রিক, আধা-মহাজনী মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল।

চুরাশীতি... কি তারই নমুনা? প্রশ্ন করছেন দেবপ্রসাদ। একটা গণঅভ্যুত্থানের মতাদর্শগত প্রস্তুতি কী ভাবে ধামাচাপা পড়তে পারে তারই নমুনা বলে সন্দেহ হয় না?

এই বিতর্কটা বন্ধুদের সামনে পেশশ করলাম।

No comments: